রাস্তা যে শেষ হয় না। সেই কোন সকালে বেরিয়েছি। বিকেল অবধি প্যডেল চালিয়ে এক জায়গায় একটি মাইলফলকে দেখি, কুমিল্লা ১০কিলোমিটার। পেছন থেকে কে যেন চেঁচিয়ে বলল, সিঙ্গেল লাইন, সিঙ্গেল লাইন। হাইওয়ে দিয়ে পাশ ঘেঁষে গাড়িঘোড়া দৌড়ে যাচ্ছে। তাই সিঙ্গেল লাইনে তো থাকতেই হবে। শেষবেলার সূর্যের লাল আভা পেছনে রেখে আমরা এগোচ্ছি। আকাশ আঁধারে ছেয়ে গেলে কুমিল্লা শহরে এসে ঢুকলাম। মোট পথের অর্ধেকও আসিনি। ২৮৩ কিলোমিটার হলো।
শরীর অবশ হতে চলেছে। তবে মনোবল হারালে চলবে না। দলনেতা মুনতাসির মামুন ইমরানের নির্দেশ, গন্তব্যে যেতে হবে যেভাবেই হোক৷ বিশেষ জরুরি কিছু না হলে গাড়িতে ওঠা চলবে না।
এই যাত্রা শুরু করেছিলাম ২৬ অক্টোবর ২০১০ সালে। দশ বছর আগে আমাদের এত ভালো সাইকেলও ছিলনা। তবে আমরা মনের আনন্দে চালিয়েছি মাইলের পর মাইল। দলে ছিলাম আমরা ১১জন, সঙ্গে আছে প্রবাসী বাংলাদেশি এবং ব্রিটিশ সাইক্লিস্ট দল।
সাত দিন ধরে সাইকেল চালাতে হবে ককক্সবাজার। শেষ পর্যন্ত পেরেছিলাম৷ পথ ছিল বন্ধুর, কিন্তু রোমাঞ্চকর।
সিলেট শহরের আলিয়া মাদ্রাসার মাঠ থেকে আমাদের সাইকেলযাত্রা শুরু হয়। এরপর মাইলকে মাইল শুধু দুই চাকার উপর বসে থাকা আর প্যডেল মারা। মসৃণ পথ পেলে মনে হয়েছে, পাখা গজিয়েছে পায়ে; আবার ভাঙ্গা রাস্তায় গেলে মনে হতো এই বুঝি শেষ। সিলেট থেকে মৌলভীবাজার, তারপর ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, ফেনী, চট্টগ্রাম ও চকরিয়া। শেষ হয় কক্সবাজার লাবনী পয়েন্ট গিয়ে। একই রকম পোশাক পরে এতগুলো মানুষ রাস্তায় নামলে মানুষের তো তাক লাগবেই -ভাই আপনারা কি চান? কই যান? লাভ কি? – কথা আর ফুরায় না। এই চলার কতনা স্মৃতি। শহর ছেড়ে বেরোলেই নিঃশ্বাস নিতাম বুক ভরে, চোখ রাঙিয়ে নিতাম সবুজে, ক্লান্ত হয়ে গেলে হাত-পা বিছিয়ে খুনসুটি করতাম। পানি, খেজুর, বিস্কুট, কলা, চিপস, ক্লেমন-এসব খেতাম আর পথ পাড়ি দিতাম। -প্রথম দিন সিলেট থেকে মৌলভীবাজার যাবার পথে খুব মজা করলাম, এই রোদ আবার এই বৃষ্টি ছিল সেদিন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পথে শ্রীমঙ্গলের চা বাগান আমাদের শরীর মন জুড়িয়ে দিয়েছিল। ব্রিটিশ বন্ধু ম্যাথিউ, ওমারিও, নাওমি আর ফিল বুকলে তো আনন্দে আত্মহারা। এত সুন্দর দেশ!
এই রাইডে ব্রিটিশ সাইকেল টিমে ছিল বার জন। তাদের দলের নেতা ফিল বুকলে। তখন তার বয়স ছিল চৌষট্টি বছর। রাস্তায় থাকতেন কিন্তু সবার আগে। বেশ কয়েক বছর হলো তিনি গত হয়েছেন।
বেশ হাশিখুশি মানুষ ছিলেন বুকলি। সব সময় আমাদের মাতিয়ে রাখতেন নানা কথা বলে। তিনি সিলেটি ভাষায় কয়েকটা বাক্য বলতে পারতেন, শুনতে বেশ ভালো লাগতো। এত মানুষের মাঝে তিনি আমাদের অনুপ্রেরণা ছিলেন সবসময়। আশা করি পরপারে তিনি ভালো থাকবেন। এই দলে ছিলেন, জিল্লুর রহমান, আঞ্জুব আলী, ওমারি উইলিয়ামস, জেবি রাহমান, নাওমি ডিক্সন, আমিনুর রহমান, জাহাঙ্গীর আহমেদ, ম্যথিও বারলো, জেলিনা রহমান, ডক্টর মোশাররফ হোসেন, মুজাহিদ খান। মুলত মুজাহিদ ভাই এই পুরো দলকে সমন্বয় করে যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছেন। আর আমাদের দলনেতা ছিলেন মুনতাসির মামুন ইমরান সঙ্গে ছিলাম আমি, মুজাক্কির, মাহবুব ভাই, সুমন, হিরা, ভাই, শরীফ, ফয়সাল আর মামুন ভাই ।
রাতে আমরা সবাই এক সাথে বসে কে কেমন চালালো, কার কি ভুল হয়েছে তা নিয়ে আলোচনা করা হতো। আমরা অনেক রাত পর্যন্ত গুলতানি করতাম। রাইডার অফ দা ডে, পারফরম্যান্স অফ দা ডে নির্বাচন করা হতো সেই আড্ডা থেকে। আমিও একদিন রাইডার অফ দা ডে হয়েছিলাম। এত বড় সফর সফল হয়েছে টিম স্পিরিট এর জন্য। ইমরান ভাই বলতেন, চালানোর সময় পায়ের সঙ্গে মাথাও চালাও। আমরা গড়পড়তায় প্রতিদিন চালিয়েছে ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার। তবে মৌলভিবাজার থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পথটুকু কষ্ট দিয়েছে। সেদিন চালিয়েছিলাম ১২৪ কিলোমিটার। প্রতিদিন রাতে বা সকালে আমরা সাইকেল গুলোর পরিচর্যা করতাম ।
আমাদের মধ্যে মুজাক্কির, শরীফ আর মনা ভাই সাইকেল সম্পর্কে বেশ ভালো বোঝেন। শরীফ ৬৪টা জেলা সাইকেল চালিয়েছে এর মধ্যেই। মনা ভাইও টেকনাফ-তেতুলিয়া সহ অনেক ক্রস কান্ট্রি বাইক রাইড দিয়েছে। মামুন ভাই নেপাল, ভুটান সাইকেলে ঘুরে এসেছে। চালানোর সময় আমাদের সঙ্গে পানি আর প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো থাকতো। সাইকেলের পেছনের চাকায় ক্যারিয়ারের সঙ্গে দুটি ব্যাগ ঝোলানো থাকে, যাকে ‘প্যনিয়ার’ বলে। এই প্যনিয়ারে রাখতাম পাম্মার মেশিন, ক্যামেরা, ফার্স্ট এইড বক্স, পানি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র।
আমাদের এই যাত্রার স্লোগান ছিল ‘রাইড ফর গ্রীন’। ক্লেমন আমাদের সহযোগিতা করেছে। যে জেলা শহরে রাত কাটাতাম সেখানে কনসার্ট এর আয়োজন হতো। আমরা জোর নাচানাচি করতাম। পরদিন সকালে শহরের তরুণরা সাইকেলে চেপে অনেক দূর পর্যন্ত সঙ্গে আসত আমাদের এগিয়ে দিতে। সন্ধ্যায় যখন আমরা কুমিল্লা টাউন হলের মাঠে এসে জড়ো হলাম, তখন ক্লেমন রাইড ফর গ্রীন লেখা মঞ্চের সামনে শত শত মানুষ। পাশে আবার মেলা বসেছিল। মজা পেলাম, আমাদের দেখতে এত লোক এসেছে! সে রাতে আমরা পল্লী উন্নয়ন একাডেমীতে (BARD) থাকলাম। সবুজ-শ্যামল নীরবতা এর সর্বত্র। সকালে উঠে দেখি, আমার সাইকেল ঝামেলা পাকাচ্ছে। মুজাক্কের এলে সব ঠিক হলো, চিন্তা গেল। বার্ড থেকে চৌদ্দগ্রাম হয়ে গেলাম ফেনী সদরে। সেখান থেকে চট্টগ্রাম শহরে। সদরঘাটের রাজ হোটেলে ছিলাম রাতে। এরপর চকরিয়ায় আরো একটি রাত কেটেছে। তবে কক্সবাজারের রাস্তা খুব ভুগিয়েছিল। পাথর টেনে ধরছিল সাইকেল। একসময় উঠে
দাড়ালাম যেখানে সমুদ্র এসে থেমেছে। গন্তব্যে এসে মনটা আর কিছু মানতে চাইল না- ঝাপ দিলাম গহীন সাগরে।