Travellers Tales Fresh Articles Every Day Your Daily Source of Fresh Adventure unleash the traveler in you

ভ্রমণ বৃত্তান্ত মেঘালয়া

বৃষ্টি শেষে বাড়ির উত্তরে গারো পাহাড় ছাপিয়ে যে সুউচ্চ পাহাড়ের দেখা মিলতো সেটিই মেঘালয়ের পাহাড়। কোনদিন ভাবিইনি সেখানে আমার পদচিহ্ন পড়বে, তাও আবার সাইকেলে! আসলে আমি সাইকেলের প্যাডেলে পা রাখবো এটাইতো কখনো ভাবিনি! কিন্তু জীবন মানুষকে বহুমুখী বিকাশের সুযোগ করে দেয়, প্রয়োজন শুধু সঠিক সময়ে সঠিক সুযোগটা লুফে নেয়া। মেঘালয়ে যাওয়ার সুযোগটা যে লুফে নিয়েছি সেটা বলবোনা। যেতে চেয়েছি কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভয়ও পেয়েছি, চালাতে পারবোতো প্রতিদিনই ৬০-৮০ কিলোমিটার!

বেশ কয়েকজনের যাওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত সঙ্গী তিনজন। সোহাগ বিশ্বাস, লাইলা নওশীন আর আমি। ৮ আগস্ট সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে সন্ধ্যার পরপরই সায়েদাবাদের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার পূর্বে অভিযাত্রীর সদস্যদের শুভকামনা আর সাহসে প্রথম প্যানিয়ার সহ সাইকেলের প্যাডেলে পা রাখি এবং দিব্যি চালিয়ে সায়েদাবাদ পৌঁছাই। সেখানে বাসের ছাঁদে সাইকেল উঠিয়ে সিলেট যাত্রার মাধ্যমে শুরু হয় আমাদের ভ্রমণ।
সিলেট কদমতলী বাসস্টপে সকাল ৭:৩০ পৌঁছে সকালের নান্তা সেরে তামাবিলের উদ্দেশ্যে চালানো শুরু করি। আগের দিন ঢাকায় সারাদিন বৃষ্টি থাকলেও সিলেটে রোদ যেনো তেতে উঠছিলো। রোদের তেতে যাওয়া ভাব দেখে যতটা ভয় পেয়েছিলাম পথের দু ধারের সারিবদ্ধ গাছগুলো নিমেষেই সেই ভয় উড়িয়ে দিলো। সুন্দর মসৃণ রাস্তা, মাঝেমাঝে গাড়ির আসা-যাওয়া। বেশ উপভোগ্য।

সিলেট ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য একটা আকর্ষণীয় জায়গা কারণ হল এর নয়নাভিরাম দৃশ্য। আমরাও এসব প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছি। কখনো লালাখালের পাশ দিয়ে, কখনো মেঘালয়ের পাহাড়কে সামনে রেখে। বারবার দৃষ্টি আটকে যাচ্ছিলো পাহাড় ফুঁড়ে নেমে আসা ঝর্ণার দেখে। ৩:৩০ এ তামাবিল পৌঁছে ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে সোজা চলে যাই ডাউকি বাজার। টাকা ভাঙিয়ে রুপি করে নিয়ে যাই খাবারের সন্ধানে। খাওয়া শেষ করে শুরু হলো আমাদের প্রথম উপরের দিকে উঠা! আজকের গন্তব্য সোনাংপেডাং।

আমরা যে রাস্তা ধরে উঠছি সেটা ট্রাকের রাস্তা। বিকেল হওয়াতে বিশাল বিশাল ট্রাকগুলো বন্দরের দিকে নেমে আসছিলো। ট্রাকগুলোর নামার ভঙ্গি দেখেই অনুমান করা যায় রাস্তা কতটা উপরে উঠে গেছে । একদম হঠাৎ করে এমন উঁচুর দিকে উঠতে থাকায় পায়ের শক্তি আর কিছুতেই কুলিয়ে উঠছিলোনা। একটু পর পর থেমেছি আবার কখনো সাইকেল ঠেলে নিয়ে উঠেছি। তবে ঠেলে উঠলে শরীর বেশি ক্লান্ত হয়। ডাউকি বাজার থেকে সোনাংপেডাং ১০ কিলোমিটারের মতো হলেও আমাদের সেখানে পৌঁছাতে রাত হয়ে যায়। অবশ্য শেষ ৪ কিলোমিটার নামা ছিলো। কারণ সোনাংপেডাং একদম নদীর কাছে। নামাটুকু অন্ধকারে চালিয়েছি। সাইকেলের লাইট আর হেড ল্যাম্পের আলোয় যতটুকু পথ বুঝা যায় ততটুকু ছাড়া।

নামার রাস্তাটা বেশ ভাঙাচুরা আর পাথুরে ছিলো। পথ চলতে চলতে ঝর্ণার উত্তাল ধ্বনি শুনতে পাচ্ছিলাম একটু পরপর। সোনাংপেডাং এ নদীর খুব কাছে একটা রিসোর্ট পেলাম। রিসোর্টে যাওয়ার পথটা একদম খাড়া। পথ যেখানে শেষ সেখানে সাইকেল রেখে নিচে নামলাম। থাকার জন্য একটা রুম পেয়েও প্রচণ্ড গরম লাগাতে তাঁবুতে থাকার সিদ্ধান্ত নিই। দুটো তাঁবু সেট করে জিনিসপত্র রেখে পাশেই একটা ঝর্ণায় গোসল সেরে এক ফ্লাক্স চা আর বিস্কুট নিয়ে তিনজন গেলাম নদীর কাছে। পড়ে থাকা বড় একটা পাথরের উপর বসে চায়ে চুমুক দিয়ে উপরে তাকিয়ে দেখি চাঁদ মামা তার ভুবন ভুলানো হাঁসি হাঁসছে মায়াবী আলো ছড়িয়ে। তবে পাহাড়ে চাঁদের আলো বোধহয় বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়না। একটু পর পর মেঘ এসে ঢেকে দিচ্ছিলো। মেঘ আর চাঁদের লুকোচুরি খেলার এই মোহনীয় পরিবেশে আরো প্রাণ সঞ্চার করেছিলো নওশীন আর সোহাগ ভাইয়ের আবৃত্তি। খুব ভোরে উঠতে হবে তাই এমন প্রাণ খোলা আড্ডার যবনিকা টানতে হয়েছে একটু পরেই।

মেঘালয় হচ্ছে মেঘেদের বাড়ি, কবিদের অনুপ্রেরণা আর চিত্রকরদের ক্যানভাস। পাহাড়ে বৃষ্টি-এক অন্যরকম ভালোলাগা। এমনই এক ভাললাগার আবেশ মনের কোণে দোলা দিয়ে গেলো সকালে ঘুম থেকে উঠেই। একটু দূরেই মেঘ উড়ে যাচ্ছে, গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিও পড়ছে। সে অবস্থায় বেরিয়ে পড়লাম। উপরে আসার পর একজন ছাতা টানিয়ে একবাটি নুডুলস নিয়ে এলো। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে খাবারটা অমৃত মনে হয়েছিলো। আগের দিনের নেমে যাওয়া চার কিলোমিটার আসতেই পথে একটা ঝর্ণা পেয়ে খালি বোতল পূর্ণ করে নিলাম। এখন আমরা মেইন রাস্তা ধরে এগুচ্ছি। রাস্তাটা বেশ আপ। নওশীনের ভাষ্য সে আপ এ চালানো শিখে গেছে। আমায় বারবার বলছিলো শরীর ছেড়ে দিয়ে রিলাক্সে প্যাডেল করতে! যেটা গতকাল সোহাগ ভাই দুজনকেই বলেছে। কিন্তু আমি কিছুতেই সেটা পেরে উঠছিলাম না। নওশীন খুব ধীরেধীরে বেশ ভালো চালাচ্ছে। আমি জোরে চালাচ্ছি বলে একটু পরপর হাঁপিয়ে উঠছি। বেশি আপ দেখলেই নেমে ঠেলতে হচ্ছে! বুঝলাম এভাবে হবেনা! আমাকেই আমার চালানোর সহজ উপায় বের করতে হবে! পেয়েও গেলাম। দেখলাম যে আমি যদি সাইকেল থেকে ৩/৪ হাত সামনে তাকাই এবং ভাবি যে আমাকে কেবল ওইটুকু উঠতে হবে তাহলে বেশ রিলাক্সে উঠতে পারি এবং এভাবে একসময় ওখানকার সবচেয়ে উঁচু জায়গাগুলোও উঠে যাচ্ছি। যদিও উঁচুর কোন শেষ নেই। এই ভাবছি যে এটাই বোধহয় সবচেয়ে উঁচু এরপর নিচু হবে কিন্তু একটু গিয়েই দেখি সেটা আগের চেয়েও বেশি উঁচু।


পাহাড় এমন এক জায়গা যার বাঁকে বাঁকে কেবল সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে। হয়তো অনেক উঁচুতে উঠে বেশ হাঁপিয়ে গেছি কিন্তু পাশেই যখন তাকিয়েছি চারপাশের অপার সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে গিয়েছি। রাস্তার ধারে অসংখ্য ঝর্ণা দেখে মুগ্ধ হয়েছি। মাটি ফুঁড়ে, পাথর বেয়ে নেমে আসা ঝর্ণার জলে মুখ ভেজালে দু-তিন ঘন্টার ক্লান্তি নিমেষে উধাও হয়ে যায়। এক পাহাড় দিয়ে যাওয়ার সময় পাশের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে তার উচ্চতা দেখে ভাবতাম ওখানে উঠতে পারবোনা, সম্ভবই না। কিন্তু ঘোরানো-প্যাঁচানো রাস্তা একসময় আমাদের ঠিক ওখানে নিয়ে গেছে। আজ তেমন দোকান চোখে না পড়াতে খাওয়াও হয়নি। তখন অব্দি পেটে সকালের সেই নুডুলস আর গুটিকয় খেজুর-বাদাম পড়েছে। একটা দোকান দেখে চিতই পিঠা, সবজি আর ছোলা (স্থানীয় নাম চানা) খেলাম। শেষে চা খেলাম। জোয়াই তখনো ৪০ কিলোমিটার। চলতি পথেই এক গ্রামের সাইনবোর্ড দেখে মেইন রাস্তা ছেড়ে দুই কিলোমিটার ভেতরে গিয়ে দেখে আসি। বেলা অনুযায়ী হিসেব মিলিয়ে দেখলাম আজ আমরা জোয়াই পৌঁছাতে পারবোনা। আগে থেকে ডাউনলোড করে রাখা ম্যাপে সোহাগ ভাই দেখলেন ক্রাংসুরীর ওখানে একটা হোমস্টে আছে। সিদ্ধান্ত নিলাম ওখানেই থাকবো। ওখানে পৌঁছাতে আমাদের সাড়ে তিনটা বেজে গেল। গোসল সেরে খাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম ক্রাংসুরী ওয়াটার ফলস দেখতে। হেঁটে যাওয়ায় আমাদের পৌঁছাতে সন্ধ্যা লেগে যায়। ক্রাংসুরী ওয়াটার ফলস খুব মনোমুগ্ধকর। ঝর্ণার পাশেই বাঁধ দেয়া লেকের জলে পা ডুবিয়ে যে প্রশান্তি পেয়েছি সেটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। রাত হওয়াই দেরি না করে উপরে এসে চা খেয়ে ট্যাক্সি করে চলে আসলাম হোমস্টেতে। সকালের গন্তব্য জোয়াই হয়ে শিলং। (আজ আমাদের ৬০ কিলোমিটার চালানোর কথা থাকলেও শুধু উঠার কারণে আমরা ২৯ কিলোমিটার চালিয়েছিলাম)।


সকাল বেলা কম্বল ছেড়ে কিছুতেই উঠতে ইচ্ছে করছিলো না। বেশ ঠাণ্ডা পড়েছিলো তার উপর সবে মাত্র ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। বাইরে বেরিয়ে দেখি কুয়াশায় চারপাশ ঢেকে আছে। পরে বুঝেছি সেগুলো কুয়াশা নয়, মেঘ। জায়গাটা একটা ভ্যালীর মতো যার কারণে মেঘ সেখান থেকে না বেরুতে পেরে এমন ঠাণ্ডা আবহাওয়ার সৃষ্টি করে রেখেছে। হোমস্টে’র দিদিকে বিদায় জানিয়ে যখন চালানো শুরু করলাম তখন ঘড়িতে ৫:৪০ বাজে। কিছুদূর চালানোর পরই ঠাণ্ডা উবে গিয়ে গা ঘামতে শুরু করলো। আজকের রাস্তাটা শুধু উঠা নয়, কখনো উঠা কখনো নামা।
নামার সময় ভীষণ মজা হয়। বেশি নামা হওয়াতে খুব দ্রুতই এগিয়ে যাচ্ছিলাম। আঁকাবাঁকা রাস্তার আশেপাশে কোন বাড়িঘর না থাকায় গহীন অরণ্য মনে হচ্ছিলো। কেবল পাহাড় আর পাহাড়। সারিবদ্ধ পাহাড়। একটার পর একটা উঠে গেছে। অনেক উঁচু হওয়াতে পাহাড়ের গায়ে গাছও কমে এসেছে! বিশেষ করে বড় গাছ খুব একটা চোখে পড়ছে না। এ জায়গার পাহাড়ের চূড়াগুলো দেখতে পিরামিডের মতো। ভীষণ ভাললাগা কাজ করছিলো। তখনো সকালের নাস্তা হয়নি। জোয়াই গিয়ে নাস্তা করবো। জোয়াই এর ৫ কিলোমিটার আগে একটা ব্রিজ পেলাম। জায়গাটা বেশ নিচু। নিচেই নদী দেখা যায়। দাঁড়িয়েছি আর হঠাৎ দুজন ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন সাথে একটা পিচ্চি মেয়ে। আলাপচারীতায় জানতে পারলাম উনারা পশ্চিমবঙ্গের লোক। শীলং বেড়াতে এসেছেন। আমাদের নাম ধাম জিজ্ঞেস করলেন, খুব বাহবা দিলেন। উৎসাহী হয়ে ছবিও উঠালেন।


সেদিন ছিলো রবিবার, সাপ্তাহিক ছুটি। রবিবার সবকিছু বন্ধ ভেবে আমরা কিঞ্চিত চিন্তায় পড়ে গেলাম কারণ আমাদের কাছে তখন রুপী খুবই অল্প আছে। শিলং যেয়ে ডলার ভাঙালে তবেই রুপী পাবো। বেলা ১১টার দিকে জোয়াই গিয়ে রুটি খুঁজলাম কিন্তু পেলামনা। তার বদলে ভাত-মাংস পেলেও দাম জিজ্ঞেস করার পর নিজেদের পকেটের দিকে তাকিয়ে সামনের পথ ধরতে হয়েছে যদি সামনে রুটি মিলে এ আসায়। একটু সামনে এগিয়েই সাধ্যের মধ্যে মাংস-খিচুড়ি খেলাম। যা রুপী ছিলো তাতে তিনজনের খাবার হয়ে দু কাপ চা ও পেয়েছিলাম। বেঁচেছিলোও বোধহয় কিছু!
আজকের রাস্তাটা আপহিল এর থেকে ডাউনহিল বেশি। ডাউন হিলে যে একবার সাইকেল চালিয়েছে একমাত্র সেই বলতে পারবে ডাউন হিল কী মজার! ডাউনে যদি কখনো ব্রেক না ধরা যায় তাহলে ডাউনের পর যে আপটুকু থাকে তাতে ডাউনের গতিতেই উঠে যাওয়া যায়। অধিকাংশ সময় প্যাডেল করতে হয়না। আমরাও তাই করছিলাম যদিও একবার খেয়াল করেছি যে আমার সাইকেলের সামনের অংশ প্রচণ্ড কাঁপছে। সাবধানতায় হালকা ব্রেক ধরে নেমেছি। সোহাগ ভাইয়ের আগেও পাহাড়ে সাইকেল চালানোর অভিজ্ঞতা থাকায় আপ-ডাউনে কি করে চালাতে হয় বেশ ভালো ভাবেই জানতেন।


আমরা যখন ‘জয়ন্তা হিল গেট’ পার হচ্ছিলাম বিপত্তিটা ঘটে তখনই। আমি যদি আমার মতোই চালাতাম তাহলে হয়তো এমন কিছুই ঘটতোনা! কিন্তু আমি সোহাগ ভাইকে ফলো করতে গেলাম, তার সমান সাইকেলে গতি উঠালাম, ব্রেক ছেড়ে দিয়ে নামা শুরু করলাম। হঠাৎ আবারো সামনের চাকায় প্রচণ্ড কাঁপুনি এবং কাঁপুনিরত সাইকেলের চাকা গিয়ে পড়লো কিছু ইটের সুরকির উপর; ফলাফল আমিসহ সাইকেল উলটে রাস্তার বা পাশে!


যখন বুঝতে পারলাম তখন হাতে খুব ব্যথা লাগছিলো। সোহাগ ভাই-নওশীন মিলে আমাকে দাঁড় করিয়ে চেক করছিলো কোথায় কোথায় আঘাত পেয়েছি। একটা মাইক্রো থামিয়ে দুজন ভদ্রলোক এসে আমাকে মেডিকেলে নিতে বললেও সোহাগ ভাই বুঝেছিলেন উনার ফার্স্টএইডেই কাজ হবে। আমার বাম হাতের কনুইয়ে একটু চামড়া ছিলে যায়। সোহাগ ভাই ক্রিম লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলেন!


ততক্ষণে বেলাও পড়ে এসেছে। চালাতে চাইলে হয়তো চালাতে পারতাম কিন্তু কেউ রিস্ক নিতে রাজি নয়। পিকআপের খোঁজে রাস্তায় দাঁড়িয়ে না পাওয়াতে সোহাগ ভাই সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। ফিরে এলেন একটা খাবারের গাড়ি করে। আমাদের বিপদের কথা শুনে দেখতে এসেছে। উনারা শিলং যেতে পারবেননা তবে গাড়ির ব্যবস্থা করে দেবেন বলে আমাদের উঠিয়ে নিয়ে পেছনের দিকে আসলেন। এবং একটা ট্যাক্সি ক্যাব ঠিক করে উঠিয়ে দিলেন।


গাড়িতে উঠে খুব খারাপ লাগছিলো নওশীন আর সোহাগ ভায়ের জন্য। বেচারাদের আমার জন্য গাড়িতে উঠতে হলো! সন্ধ্যার সামান্য আগে আমরা শিলং পৌঁছালাম। ডলার ভাঙ্গিয়ে ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে তিনজন সাইকেল নিয়ে হোটেলে গেলাম। ততক্ষণে রাত হয়ে গেছে। ফ্রেশ হয়ে খাবার খেলাম এক বাঙালি হোটেলে। খেয়েদেয়ে গেলাম পুলিশ বাজারে। সামান্য কেনাকাটা শেষে চা খেয়ে গেলাম ঔষধের দোকানে। প্রয়োজনীয় ঔষধ নিয়ে রুমে আসার পর স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠলো কাল কি করবো!


আমার সহজ উত্তর সকালে দেখা যাবে। শরীর টানলে অবশ্যই চালাবো! পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে শরীর বেশ ফুরফুরে লাগছিলো। ব্যথা অনেকটাই কমে গেছে। ভাবলাম শুরু করে দেখি অন্তত! শিলং শহরের শেষ মাথায় এসে নাস্তা করে চালানো শুরু করি। আজ আমরা বিশেষ করে আমি ভীষণ সাবধানী! কিছুদূর এসেই পেলাম এলিফেন্ট ফলস। মেইন রাস্তা থেকে ডানে মোড় নিয়ে সামান্য এগিয়ে গিয়ে দেখতে হয় এই ফলস। দেখতে গিয়ে মনে হলো আমরা এর চেয়ে ঢের সুন্দর ফলস দেখে এসেছি! এখান থেকে বেরিয়ে আবার চালানো শুরু করি। আজকের রাস্তায় আপের চেয়ে ডাউন হিল বেশি। এমন অবস্থা হয়েছে যে ডাউনে নামার সময় ব্রেক চেপে রাখতে রাখতে হাত ব্যথা হয়ে গেছে! এ রাস্তায় গাড়ির আধিক্য বেশি। একটু পর পর দোকান-পাটের দেখা পাওয়া যাচ্ছে।


আজকের আকাশটা একটু বেশিই সুন্দর! হঠাৎ হঠাৎ এমন পুঞ্জিভূত সাদা মেঘ চোখের সামনে এসে ধরা দেয় যে মনে হয় একটা আস্ত শিমুল গাছের তুলো উড়িয়ে দেয়া হয়েছে আর সেগুলো উড়ে উড়ে এক জায়গায় গিয়ে দলা পাকিয়ে অন্য দিকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। হিসেব করে দেখলাম শরৎকাল আসন্ন। শুধু মেঘের ভেলা দেখে মুগ্ধ চোখে কতবার চালানো থামিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। একবার একটা রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়েছি, রাস্তাটা বেশ বেঁকে গেছে। ঘুরে যাওয়া চারপাশটা এতো সুন্দর যে চেঁচিয়ে নওশিন কে বললাম এটা না দেখলে মিস হয়ে যাবে!
দাঁড়ালাম দুজনেই। কিন্তু পেছন থেকে সোহাগ ভায়ের দেখা নেই। ভাইয়া আসলেন কিছুক্ষণ পর মোবাইল রিচার্জ করে। আজ ঈদ। আমি আর নওশীন বেশ কয়েকবার বলেছিলাম বাড়িতে কথা বলবো। হঠাৎ সেখানে একটা মাইক্রো আর মোটরসাইকেলে করে শিলং এর ৩/৪ জন ছেলে এসে দাঁড়ালো। কথা বলার পর আমার আর নওশীনের গায়ে বাংলাদেশের টিশার্ট দেখে এরকম একটা টিশার্ট চাইলো স্মৃতি হিসেবে রাখবে বলে।
কিন্তু আমাদের কাছে অতিরিক্ত টিশার্ট না থাকায় সোহাগ ভাইয়ের ‘শোক থেকে শক্তি’ টিশার্টটা দেওয়া হল। ছবি তুলে চলে যাওয়ার আগে নওশীনের রঙিন চশমার বদলে ওকে কালো চশমা দিয়ে যায়। পরে ওই ছেলেগুলোকে রাস্তায় দেখেছি সেই টিশার্ট গায়ে আর চশমা চোখে ঘুরতে। দেখে বেশ ভালো লেগেছিলো।


চেরাপুঞ্জির রাস্তায় উঠার কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম জিপলাইন। ৪টা রুপ করা, একেকটা রুপ ২০০ রুপি। সোহাগ ভাই ৪টাই করলেন ৮০০ রুপি দিয়ে। নওশীন করলো দুটো ৪০০ রুপি দিয়ে। হাতে ব্যথা থাকায় আমি আর রিস্ক নেইনি। হঠাৎ সামনে তাকিয়ে দেখি দূরে যতদূর চোখ যায় ঠিক ততদূর পর্যন্ত আমাদের যাওয়ার রাস্তাঁ া উঠে গেছে উপরের দিকে। কিন্তু ভয়ংকর ব্যাপার হলো -এখান থেকে রাস্তাঁ া দেখতে মনে হচ্ছে পাহাড়ের গায়ে কোন রকম ঝুলে আছে! ডানপাশে পাহাড় যেন দেয়াল হয়ে দাঁ ড়িয়ে আছে, বাম পাশে আবার নেমে গেছে একদম নিচে নদীর কাছে। মনে হচ্ছে ওখান দিয়ে যাওয়ার সময় একটু এদিক ওদিক হলেই বুঝি শেষ! একেবারে খাঁদে! সোহাগ ভাইকে বললাম যাবোনা ওই রাস্তায়। ভয়ংকর ওটা!


তিনি সেটা উড়িয়ে দিয়ে বললেন দূর থেকে ওইরকম মনে হলেও আসলে তেমনটা নয়! দুরুদুরু বুকে এগুনো শুরু করে বুঝলাম আসলেই তেমনটা নয়। বাঁ পাশে বেশ খানিকটা জায়গা আছে। ভয় কেটে গিয়ে ভালোলাগা শুরু হলো! সত্যি বলছি এখন পর্যন্ত আমার সাইকেল চালানোর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর রাস্তা এটা। শুধু সুন্দর নয়, ভয়ংকর সুন্দর! চেরাপুঞ্জির আগ পর্যন্ত প্রায় ১৮ কিলোমিটার অসাধারণ রাস্তায় চালিয়ে চেরাপুঞ্জির স্থানীয় নাম শোহরা পৌঁছালাম সন্ধ্যে ৬ টায়।


এক খাশিয়া দিদি এসে আমাদের একটা হোমস্টে ঠিক করে দিলেন। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ উনার হোটেলে রাতের খাবার খাবো বলে ঠিক করলাম। আমাদের আজকের হোমস্টেটাও খুব সুন্দর। দ্রুত ফ্রেস হয়ে খাবার খেতে দিদির হোটেলে প্রবেশের ঠিক আগ মুহূর্তে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম জুনায়েদ ভাইকে দেখে। এরপর অপরাজিতা, রফিক ভাইয়া, নিশু আপু, আরিফ ভাই, জেসির সাথে দেখা। ঈদের আনন্দ দিগুণ হলো মুহূর্তেই।


খাবার খেয়ে ওদের সাথে ছোট খাটো একটা আড্ডা দিয়ে গেলাম ওষুধের দোকানে। হঠাৎ অনুভব করলাম মেঘ যেনো গা ছুঁয়ে যাচ্ছে বারবার। প্রয়োজনীয় ঔষধ নিয়ে ফেরার সময় আসলো বৃষ্টি। কোন রকম গা বাঁচিয়ে ফিরলাম হোমস্টেতে।


কাল চেরাপুঞ্জি ঘুরে দেখার প্ল্যান করে আজকের মতো ঘুম।


রাতে কয়েক দফা বৃষ্টি হয়েছে। ভোরে মেঘের কুয়াশা কাটতে শুরু করলেও ঠাণ্ডা হিমেল বাতাস শরীরটা জমিয়ে দিচ্ছিলো। দ্রুত রেডি হয়ে গায়ে উইন্ডব্রেকার চাপিয়ে বেরিয়ে পড়লাম চেরাপুঞ্জির আশপাশটা ঘুরে দেখবো বলে। রাস্তায় এসে এক ট্যাক্সিচালকের কাছে জানতে চাইলাম লিভিংরুট ব্রিজে যেতে কতক্ষণ লাগবে? উনি বাংলায় বললেন তোমরা কাল সাইকেল চালিয়ে এসেছো না?


অবাক হলাম আবার ভালোও লাগলো! এতো গাড়ির মধ্যেও উনারা আমাদের খেয়াল করেছেন। পরে জানতে পারলাম উনি বাঙালি। থাকেন ডাউকিতে বাপ দাদারা ছিলেন সিলেটের। বাংলা হিন্দি ইংরেজি খাশিয়া চারটি ভাষাতেই বেশ পটু। ভাড়া ঠিক করে গাড়িতে উঠলাম। উনি আমাদের লিভিংরুট ব্রিজে যাওয়ার সিঁড়ি পর্যন্ত নামিয়ে দিয়ে আসবেন। যাত্রা পথে উনার সাথে অনেক গল্প হলো একসাথে চাও খেলাম। নকালিকা ফলসের নামকরণের ইতিহাস শোনালেন এবং ফেরার রাস্তা বলে আমাদের ছেড়ে দিয়ে এলেন।


সকালে চা ছাড়া আর কিছু খাওয়া হয়নি। দীর্ঘ সময় ধরে ট্রাকিং করতে হবে! তাই দোকান পেয়ে বিস্কুট এবং জল নিয়ে শুরু করলাম হাঁটা। খাড়া সিঁড়ি বেয়ে অনেকটা নিচে নামার পর ডানে গিয়ে পেলাম একটা লিভিংরুট ব্রিজ। গাছের ডাল-শেকড় পেচিঁয়ে পেঁচিয়ে ব্রিজ হয়েছে। জানতে পারলাম এটা ছাড়াও আরেকটা ব্রিজ আছে, ডাবল। চললাম সেদিকে। এখানে এক দোকানে নুডুলস খেলাম সাথে স্থানীয় ফলের জুস, জুসটা তেমন স্বাদের নয়।


এবার মূল ট্রাকিং শুরু! ডাবল ব্রিজে পৌঁছাতে হলে সব মিলিয়ে আমাদের প্রায় পনেরোশত বা কিছু কম-বেশী সিঁড়ি নামতে হবে! নেমে আসা সহজ মনে হলেও খাড়া সিঁড়ি বেয়ে নামাটা বেশ কঠিন। শরীর হাঁপিয়ে না উঠলেও পায়ের শক্তি কমে আসে ধীরেধীরে এবং পা কাঁপতে থাকে; মনে হয় এই বুঝি সামনের দিকে ভেঙে পড়বে!


তবে এই রাস্তাটা অনেক বেশী সুন্দর। উপরে তাকালে পাহাড় ফুঁড়ে নেমে আসা ঝর্ণা আর নিচে সেই ঝর্ণাগুলোর মিলিত স্রোতধারার অবিরাম বয়ে চলা। এক অদ্ভুত সৌন্দর্যের নেশায় পড়ে গেলাম। সামনে যত এগুচ্ছি প্রকৃতি যেন তত সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে রেখেছে। এক পাহাড়ের সাথে অন্য পাহাড়ের সংযুক্তি ঘটানো ঝুলন্ত ব্রিজ পার হওয়ার সময় ব্রিজের দুলুনিতে নিচের দিকে তাকিয়ে ভয়ংকর মনে হলেও তার নয়নাভিরাম দৃশ্যে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। একদম নিচেই বিশাল গর্জনে ছুটে চলেছে ঝর্ণা। বড় বড় পাথরের গায়ে আছড়ে পড়ে পানির গর্জন যেন বহুগুণ মাত্রা পেয়েছে। এই ঝর্ণাগুলোই বহু পথ-ঘাট-বন পেরিয়ে এসে এক সময় স্রোত কমে গিয়ে নদীর মত বয়ে চলে দেশ দেশান্তরে।


সবগুলো সিঁড়ি শেষ করে একসময় পৌঁছালাম ডাবল ডেকার ব্রিজে! দেখা শেষে ফিরে আসলাম উপরে। এখান থেকে বেরিয়ে গেলাম ইকো পার্ক আর পাশেই বাংলাদেশ ভিউ পয়েন্ট দেখতে। পার্কে গাড়িতে যাওয়ার কথা ভেবেও ওখানকার স্থানীয় একজনের কাছে দূরত্ব জেনে নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। হাঁটার শুরুতে প্রচণ্ড রোদ থাকলেও হঠাৎ রোদ থেমে গিয়ে মেঘ জমতে শুরু করলো এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হলো। ঠাণ্ডা আবহাওয়ার কারণে গায়ে প্রচণ্ড কাঁপুনি হচ্ছিলো। পার্কে দাঁড়িয়ে চা খেয়ে পা বাড়ালাম বাংলাদেশ ভিউ পয়েন্টের দিকে।


আহা! কী অপূর্ব দৃশ্য! অপরূপ মাতৃভূমি আমার! হয়ত বিদেশে অবস্থান করছি বলে তার রূপ আরো মোহনীয় হয়ে উঠেছিলো। মুগ্ধতা ছড়াচ্ছিলো মনের কোণে ! অবাক চোখে দেখছিলাম-ওই যে জল-মাটিতে মিশে একাকার হওয়া একখন্ড ভূমি; যেখানে মাটির চেয়ে জলের অস্তিত্বই বেশি মনে হচ্ছে, যার বুক ফুঁড়ে মায়াবী আলোর রোশনাই এখান থেকেও ঝলকানি দিচ্ছে! ওখানেই মিশে আছে আমার অস্তিত্ব হঠাৎ ওখানে দাঁড়িয়ে মনে হলো ওই জায়গাটুকু আমি ভীষণ ভালবাসি। অতো উঁচুতে দাঁড়িয়েও তার যেটুকু পরিধি দৃষ্টি সীমায় আটকে যাচ্ছিলো তাই দেখে নিচ্ছিলাম মুগ্ধ চোখে। কিন্তু সে দেখায় আবারো কালো মেঘ এসে বিচ্ছেদ ঘটালো। শুরু হলো বৃষ্টি।


তাই সময় নষ্ট না করে দুই কিলোমিটার দূরে গুহা দেখতে বেরুলাম। ভেবেছিলাম রাস্তায় হয়ত গাড়ি পাবো কিন্তু সব গাড়িই রিজার্ভ আসছে। অনেকটা বাধ্য হয়েই হাঁটতে লাগলাম। এদিকে বেলাও পড়ে আসছে। আকাশের মতিগতি দেখে মনে হচ্ছে আজ আর সে তার মন ভার কমাবে না !
টিকিট কেটে গুহায় প্রবেশ করতে হয়। পুরোটা দেখতে বোধহয় আধা ঘন্টার মত লেগেছিলো। বাইরে তখন হালকা বৃষ্টি কিন্তু কুয়াশায় চারপাশ ঢেকে আছে। ওখানকার একজন ফোন করে আমাদের একটা ট্যক্সিক্যাব আনিয়ে দিলেন। ধন্যবাদ জানিয়ে ট্যাক্সিতে চড়ে গেলাম সেভেন সিস্টার্স ফলস দেখতে। গাড়ি থেকে নেমে পয়েন্টে দাঁড়িয়ে ফলসের দিকে মুখ ঘুরিয়ে ঝাপসা কিছু দেখেছি কি দেখিনি আবার শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। উপায় না পেয়ে চলে আসলাম হোমস্টেতে। ফলসের দিকে আসার সময়েই জেনেছি যে নকালিকা ফলস তখন বন্ধ হয়ে গেছে। আর আকাশের যা অবস্থা তাতে ওখানে গেলেও খুব একটা লাভ হতোনা। রুমে এসে উষ্ণ গরম জলে গোসল সারার পর মনে হলো সারা শরীরে রাজ্যের ক্লান্তি এসে ভর করেছে। ঘুমিয়ে গেলাম। কালকের গন্তব্য এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম মাউলিলং।


অতিরিক্ত ক্লান্তিতে রাতে বেশ ভালো ঘুম হলো। আজকে ভোর ৫টায় আমরা সবকিছু রেডি করে বেরিয়ে পড়লাম। বাইরে তখন বৃষ্টি। চারদিকে মেঘের কুয়াশা সব ঢেকে রেখেছে। সাইকেলে লাইট লাগিয়ে নিয়ে নিজেরাও রেইনকোট পরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতেই চালানো শুরু করেছি। সামনে আমরা খুব বেশি হলে বিশ হাত পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছিলাম। ভাবলাম বেলা বাড়ার সাথে সাথে হয়তো কুয়াশা কেটে যাবে কিন্তু না, উল্টো মেঘ আরো ঘনিভূত হতে লাগলো। দুদিন আগে দুইধারে যে সৌন্দর্য দেখতে দেখতে এসেছিলাম আজ তার ছিটেফোঁটাটাও দেখতে পেলামনা। তবে আজ মনের মধ্যে এক অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করছিলো। মেঘের ভেতর সাইকেল চালাচ্ছি! একজীবনে এই সুযোগ ক’জনের ভাগ্যেই বা হয়!


এদিকে বৃষ্টি থামার কোন লক্ষণই নেই। দফায় দফায় চলছিলো। রেইনকোট ভেদ করে শরীর না ভিজলেও আমার চশমা বারবার ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিলো। যার কারণে একটু পরপর থেমে চশমা মুছতে হচ্ছে। এতো মহা মুশকিল! এভাবে কতক্ষণ! এবার আর ভেজা গ্লাস মুছাও যাচ্ছেনা। বাইরে আর কিছু শুকনো নেই, তাই বাধ্য হয়ে চশমাটা খুলেই চালাতে লাগলাম।


এখন বেশ শীত করছে। রেইনকোটেও গা গরম হচ্ছেনা। হঠাৎ করেই বৃষ্টির জোর যেন বেড়ে গেলো। দোকান দেখে থামলাম। ঠাণ্ডায় রীতিমত কাঁপতে ছিলাম তখন। দোকানে প্রবেশ করে চায়ের অর্ডার দিয়ে বসার পর দোকানের দিদি আগুনের কয়লা সমেত একটা পাতিল এগিয়ে দিলেন হাত পা সেঁকে নেয়ার জন্য।


বৃষ্টি কমলে আবার চালানো শুরু করলাম। ১০ মিনিট যেতে না যেতেই আবারো বৃষ্টি। এবার মনে হলো বৃষ্টির ফোঁটা বাঁকা হয়ে পড়ছে আর সরাসরি চোখে আঘাত হানছে। নাহ্, এবার আর বেশি এগুনো গেলোনা, দোকান দেখে থামলাম। গা থেকে তখন টপটপ করে জল ঝরছে তবুও ওরা ভেতরে বসতে দিলো। ওদের বানানো ঝালমুড়ি আর কফি খেলাম। কিছুক্ষণ বসার পর বৃষ্টি একটু কমলে আবার বেরিয়ে পড়লাম। আজকে কেবল নামছি আর নামছি। ব্রেক ধরে রাখতে রাখতে আমার আর সোহাগ ভাইয়ের ব্রেকশো বদলাতে হয়েছে। আগেরটা আর কাজ করছিলোনা।


এদিকের রাস্তাগুলো অন্যরকম, বিস্তৃত খোলা মাঠের মতো। হয়তো দূরে কোথাও গ্রাম, কাঁশবনের মতো ঝোপঝাড়। বৃষ্টির ঘনঘটা তখন থেমে গেছে। শেষ বিকেলের মায়াবী আলোয় সে মাঠকে তখন তেপান্তরের মাঠ মনে হচ্ছিলো। যেন এটি পার হতে পারলেই পৌঁছে যাব এক অচিনপুরে। মাঝেমাঝে দু-একটা গাড়ি সাঁই করে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মোহ ভেঙে দিয়ে গেছে। এভাবে করে একসময় আমরা কাঙ্খিত জায়গায় চলে আসলাম। এখান থেকে সোজা ২০ কিলোমিটার সামনে এগুলে ডাউকি আর ডানে মোড় নিয়ে ১৮ কিলোমিটার ভেতরে গেলে মাউলিলং গ্রাম।
তখন পড়ন্ত বিকেল। মাউলিলং এর রাস্তাটা বেশ সরু আর এক ল্যানের। বিকেল হওয়াতে গাড়ির আধিক্যও বেশি। কেউ কেউ রাতে থাকবে বলে গ্রামের দিকে যাচ্ছে, আবার কেউ সারাদিন ঘুরে এখন বেরিয়ে যাচ্ছে। বেশ সাবধানে চালাতে হচ্ছে আমাদের। অবশেষে ঠিক সন্ধ্যে নামার মুখে আমরা গিয়ে পৌঁছালাম মাউলিলং গ্রামে। ছবির মতো সাজানো গোছানো গ্রাম। একপলকেই হৃদয়পটে এর ছবি গাঁথা হয়ে গেলো।


চমৎকার একটা হোমস্টে পেলাম। হোমস্টের ছেলেটা খুবই আন্তরিক। ফ্রেস হওয়ার সাথে সাথেই চা বি¯ু‹ট দিলো এবং রাতের খাবারের উদ্দেশ্যে এক দিদির হোটেলে নিয়ে গেলো। দিদি আমাদের মেন্যু জেনে রান্নার জন্য দেড় ঘন্টা সময় নিলে এ সময় আমরা গ্রামের চারপাশটা ঘুরে দেখলাম। বড় একটা গীর্জা, বিভিন্ন দোকান, কিছু কেনাকাটাও হলো। দেড় ঘন্টা পর গিয়ে গরম গরম চমৎকার সব খাবার খেয়ে হোমস্টেতে ফিরে আসলাম।
মাউলিলং গ্রামের ভোরটা হলো অন্যরকম। উঠে দেখি বৃষ্টি পড়ছে। রেডি হয়ে বারান্দায় বসে বসে এতো সুন্দর-পরিচ্ছন্ন গ্রামের ভোর আর বৃষ্টির অবিরাম ঝরে যাওয়া দেখছিলাম। আজ বাংলাদেশে ফিরবো তাই ঘটে যাওয়া দিন এবং মেঘালয়ার স্থানীয় পরিবেশ ও প্রকৃতি নিয়ে ভাবছিলাম। বর্ষার প্রাচুর্য থাকায় মেঘালয়া সবুজ শ্যামল স্বভাবতই; তবে ধীরে ধীরে উঠা কিংবা সাঁই করে নেমে যাওয়ার মাঝেও প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড খ্যাত মেঘালয়ার ভ্যালী গুলো যতই দেখেছি ততই মুগ্ধ হয়েছি! প্রচুর ফুল ফুটে আছে পথের দুধারে। ঘাসের কার্পেটের মাঝে যেন রঙ্গিন নকশা! লাল, হলুদ, কমলা, সাদা রঙ ছাড়াও বেগুনি ফুলের আধিক্য ছিল। বসত বাড়ি গুলোতে বিভিন্ন রঙ্গের ফুলগাছ, তবে প্রাকৃতিক ভাবে অযত্নে ফোঁটা ঘাস ফুলগুলো আমায় বেশি আকর্ষণ করেছে। এছাড়া ফার্ণ ও পাইনগুলো মেঘালয়াকে অন্য রকম এক মাত্রা দিয়েছে। সাদাসিধা পোশাক পরা মানুষ গুলোর ধৈর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছি। তারা অনবরত ঝরে পড়া মুষলধারার বৃষ্টিতেও বিরক্ত নয়! জীবন কে আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে কাজের ছন্দ ঠিক ধরে রেখেছে। কম আওয়াজ করে কথা বলে তারা।


বৃষ্টি কমে যাওয়াই বেরিয়ে পড়লাম ডাউকির উদ্দেশ্যে। আমরা বর্ডার বরাবর যে রাস্তা সেটা ধরে এগুতে থাকলাম। এ রাস্তায় সাধারণত উপায় না থাকলে কেউ সহজে গাড়ি নিয়ে আসেনা কারণ প্রায় পুরোটা রাস্তা পাথরে ভর্তি; এবড়ো থেবড়ো কাদায় মাখামাখি। খুব সাবধানে চালাতে হচ্ছে।
আমাদের পুরো ভ্রমণে যে থ্রিলারটা বাকী ছিলো এবার এটার মাধ্যমে ষোলো কলা পূর্ণ হলো। আজো যেন বৃষ্টি পণ করেছে সে থামবে না, তাই ঝরেই চলেছে অবিরাম গতিতে। আমরাও কিছুটা ভয়-তৃষ্ণা-ক্ষুধা নিয়ে এগিয়ে চলেছি কারণ এ রাস্তায় কোন দোকান নেই। চলার পথে আমাদের বা পাশে মেঘালয়ের উঁচু পাহাড় ডান পাশে বাংলাদেশের সমতল ভূমি। মাতৃভূমি দেখতে দেখতে অন্য একটা দেশে সাইকেল চালাচ্ছি এ আনন্দটা অন্যরকম। ভীষণ ভালোলাগার! আমরা যে পাহাড় ঘেঁষে সাইকেল চালাচ্ছিলাম এটা মেঘালয়ের শেষ পাহাড়। শেষ পাহাড় হওয়াতে ছোট বড় অসংখ্য ঝর্ণা নেমে এসেছে এ পাহাড়ের গা ফুঁড়ে। ডাউকি পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার চালিয়ে আসতেই আমরা প্রায় ২৫ টা ঝর্ণা দেখেছি। বড়হিল বা পান্থুমাই ঝর্ণা পেরিয়ে জাফলং থেকে দেখা ব্রিজের উপর দিয়ে আসার সময় বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে দেখেছি জাফলং লোকে লোকারণ্য।
ডাউকি বাজারে কেনাকাটা করে যখন তামাবিল ইমিগ্রেশনে আসি তখন বেলা ৩টা বাজে। ইমিগ্রেশনে তিল ধরার ঠাই নেই। কিছুটা ভড়কে গেলেও ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ হলো দ্রুতই। এবার ফেরার পালা। পিকআপে সিলেটে এসে রাতের বাসে রওনা দিলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। আর এখান থেকেই আমাদের সাইকেল ভ্রমণ এবারের মতো সমাপ্ত ।

Share Article:

Shilpi Jannat

Writer & Blogger

All content published on Jatrik Blog is the intellectual property of the respective authors. Jatrik Blog serves as a platform for sharing these personal travel experiences with the world.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

যাত্রিক - Jatrik

যাত্রিক-এ আমরা বিশ্ব আবিষ্কারের প্রতি গভীর আগ্রহী এবং মনোমুগ্ধকর ব্লগ এবং ভ্লগের মাধ্যমে ভ্রমণের আনন্দ শেয়ার করি। আমাদের মিশন হলো সহযাত্রী ভ্রমণকারীদের মধ্যে ভ্রমণের ইচ্ছা জাগানো, প্রয়োজনীয় পরামর্শ, চমৎকার দৃশ্যাবলি এবং আমাদের অভিযানের প্রামাণিক গল্পের মাধ্যমে।

আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আমাদের পাঠান, যাতে তা জাত্রিক বাংলা ব্লগে শেয়ার করা যায়। লেখা পাঠান এই ঠিকানায়ঃ

jatrik.com@gmail.com

ইন্সটাগ্রাম এ ফলো করুন

সর্বোশেষ পোস্ট সমূহ

  • All Post
  • ঐতিহাসিক
  • খাবার গল্প
  • পাহাড় ও পর্বত
  • ফটোগ্রাফি
  • বাংলাদেশ
  • বিদেশ ভ্রমন
  • ভ্রমন

Visit kunjori

for your desired jewellery collection

আমাদের সাথে যোগ দিন

ণিউজলেটার এর জন্য সাইন আপ করুন

You have been successfully Subscribed! Ops! Something went wrong, please try again.
Edit Template

যাত্রিক

স্বাগতম যাত্রিক ব্লগ সাইটে, যা আপনার যাত্রার প্রেরণা, গল্প এবং পরামর্শের নির্ভরযোগ্য স্থান। যাত্রিক ইভেন্টস অ্যান্ড ট্রাভেলস-এর একটি সহযাত্রী প্রতিষ্ঠান হিসেবে, আমরা আপনাকে বাংলাদেশের জনসাধারনের হৃদয়ের কাছাকাছি নিয়ে আসার লক্ষ্যে কাজ করছি।

সাম্প্রতিক পোস্ট

  • All Post
  • ঐতিহাসিক
  • খাবার গল্প
  • পাহাড় ও পর্বত
  • ফটোগ্রাফি
  • বাংলাদেশ
  • বিদেশ ভ্রমন
  • ভ্রমন

সোশাল মিডীয়া লিঙ্ক

© 202৪ Copyright Jatrik.com