Travellers Tales Fresh Articles Every Day Your Daily Source of Fresh Adventure unleash the traveler in you

কেওক্রাডং: পাহাড়ে সবকিছুই অতিরিক্ত!

এই গল্পটা একেবারেই অন্যরকম। একটা মেয়ে নিজেকে নতুন করে চেনার গল্প… একটা ছেলের অনুভূতির গল্প… ছোট্ট একটা বাচ্চার অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠার গল্প… অচেনা কয়েকজন পথযাত্রীর খুব বন্ধু হওয়ার গল্প…


ফেসবুকে ট্রাভেল গ্রুপগুলোতে সক্রিয় থাকার সুবাদে টিজিবির সাথে পরিচয়। সবার পোষ্ট দেখতাম আর টিজিবির ভূয়সী প্রশংসা পড়ে ভাবতাম ওদের সাথে একটা ট্যুর দেয়া দরকার। ভাবতে ভাবতেই ওদের কেওক্রাডং সামিটের ইভেন্ট চোখে পড়ে মুশতাকের। একে তো নাচুনে বুড়ি, তার উপর ঢোলের বাড়ি পড়লো আর কি! কিন্তু আমি, যার নাকি উচ্চতা ভীতি মারাত্মক… তার পাহাড়ে যাওয়া? তার উপর ৪ বছরের মেয়ে নিয়ে! অসম্ভবের কাছাকাছি। মুশতাককে বললাম, ‘মেয়ে তো পুরো পথ কোলেই থাকবে, তুমি পারবা?’ মুশতাক জবাবে বললো, ‘তোমাদের দুইজনকেই সামলাতে পারবো।’ কি আছে আর জীবনে! রাজি হয়ে গেলাম।


২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি ১৫ তারিখ রাতে ফকিরাপুল থেকে ডলফিন পরিবহনে রওনা হবো। হাজির হলাম সময়মতো কাউন্টারে। ওখানে হোষ্ট ইমরান ভাই আগে থেকেই ছিলেন। পরিচয় হয়ে গেল। আরেকজন আপু বসে ছিলেন। কথায় কথায় জানা গেল, উনি ফিজিওথেরাপিস্ট শান্তি বর্মণ। আমাদের সাথে ছিল বন্ধু সৈকত। আস্তে আস্তে আমাদের গ্রুপের ১২ জন সদস্য চলে আসলো। তখন শুধু মুখ দেখাদেখি হলো। কারণ বাস এসে গিয়েছে।


বাস ছাড়ার পরই যথারীতি আমরা ঘুমে তলিয়ে গেলাম। হঠাৎ ঘুম ভাঙলে দেখি বাস থেমে আছে আর আমাদের ড্রাইভার সাহেব চরম মার খাচ্ছেন। একটা মাইক্রোর গায়ে ধাক্কা লাগার ফলস্বরূপ মারধর। ওখানেই অনেকটা সময় চলে গেল। মনে মনে ভাবছিলাম কুফাটা মনে হয় লেগেই গেল। ঠিকই… রাত তিনটার দিকে কুমিল্লার কাছে দেখি গ্রীন লাইনের একটা বাস মারাত্মকভাবে পড়ে আছে রাস্তার পাশে। আমরা যাত্রাবিরতির পর বাসে উঠে বসতেই কোত্থেকে একটা লরি এসে ধাক্কা দিয়ে গেল। অল্পের উপর দিয়ে গিয়েছে, নাহলে শিরোনাম হয়ে যাওয়া লাগতো। এরপর সারারাত আর ঘুমাতে পারিনি!


ভোরের সূর্য যখন উঁকি দিচ্ছে, তখন আমরা ফেনীতে। রাতের ভয়াল স্মৃতি মুছে গেল মন থেকে। আমার মন-প্রাণ তখন ফেনীতে, আমার বাড়িতে! ফেনী পার হয়ে চিটাগাং এর পটিয়ায় আটকে গেলাম। প্রায় ঘন্টা তিনেক একই জায়গায়। বেলা যখন প্রায় বারোটা বাজে, আমরা অবশেষে বান্দরবান পৌঁছালাম। ভোরে পৌঁছানোর কথা ছিল। কিন্তু দেরি হয়ে যাওয়াতে আমাদের পরিকল্পনাও তাই বেশ কিছুটা ওলট-পালট হয়ে গেল। বান্দরবান পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে, খেয়ে রওনা হলাম রুমা বাজারের উদ্দেশ্যে। চান্দের গাড়িতে সবার সাথে পরিচয় হয়ে গেল। আমাদের সাথে আরো ছিলেন তরিকুল ভাই-আয়শা আপু, তুহিন আপু-ভাইয়া, রাসেল ভাই আর ইমন ভাই।


বগালেক যেতে সবচেয়ে বাজে লেগেছে বারবার আর্মি চেকপোষ্টে এন্ট্রি দেয়া। প্রথমে রুমা বাজার নেমে আর্মি চেক ছিল। রীতিমতো একটা অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করতে হয়েছে। লেকের পানিতে গোসল করা যাবে না, আর করলে যদি মৃত্যু হয় তাহলে কেউ দায়ী থাকবে না! এরপর আরো একবার এন্ট্রি দিতে নামতে হলো। এইবার পুলিশ চেক। সে কিছুতেই আমাদের বগালেক যেতে দিবে না। দুপুর ৩টার মধ্যে পৌঁছাতে না পারলে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয় না। হঠাৎ কোত্থেকে এক লোকের আগমন। দায়িত্বরত পুলিশকে ইচ্ছামতো বকাঝকা করলেন। জানা গেল, ওনার নাম লালা বম। কেওক্রাডং এর হেডম্যান। ওনার হাত থেকে বাঁচতেই কিনা কে জানে, পুলিশ আমাদের ক্লিয়ারেন্স দিয়ে দিল। বগালেক যখন পৌঁছাই, প্রায় সন্ধ্যা। সেখানে শেষ আর্মি চেকপোষ্টে নাম-ধাম লিখে আমরা কটেজে উঠলাম। বিশাল একটা কাঠের ঘর। একটা ঘরেই অনেকগুলো খাঁট। সবাই একসাথে একই ঘরে। মনে হচ্ছিলো বিগ বসের নতুন সিজন শুরু হয়েছে!


বগা লেক নিয়ে এখানে কিছু বলা উচিত। অনেক গল্প আছে এই লেকের জন্ম নিয়ে। বিতর্ক আছে এর নামকরণ এবং উচ্চতা নিয়েও। তবে বগা লেকের সৌন্দর্য নিয়ে কারো কোন দ্বিমত নেই। দূর থেকেই চোখে পড়ে এই অদ্ভুত সুন্দর সবুজ লেক। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২৭০০ ফুট উঁচু পাহাড়ে ১৫ একর জায়গা জুড়ে প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট এই বগা লেক। ভূ-তত্ত্ববিদগণের মতে প্রায় দুই হাজার বছর আগে এই লেকের সৃষ্টি। মৃত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ কিংবা মহাশূন্য থেকে উল্কাপিণ্ডের পতনের ফলে সৃষ্টি হয়েছে। কেওক্রাডং এর কোল ঘেঁষে বান্দারবান শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে এবং রুমা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান। আকাশের নীল আর চারপাশের পাহাড়ের সবুজ রঙ লেকের স্বচ্ছ পানিতে মিলে যায় যখন, লেকটা তখন ঠিক যেন একটি নীলাম্বরী চাদর। বগা লেক নিয়ে দারুণ একটা কল্পকাহিনীও আছে। বগালেককে অনেকে ড্রাগনলেকও বলে থাকে। অনেক অনেক দিন আগে নাকি একটি চোঙা আকৃতির পাহাড় ছিল। দুর্গম পাহাড় ঘন অরণ্যে ঢাকা। পাহাড়ের কোলে বাস করত নানা নৃগোষ্ঠীর মানুষ। সেই পাহাড় নিকটবর্তী গ্রামগুলো থেকে প্রায়ই গবাদিপশু আর ছোট শিশুরা ওই চোঙ্গা আকৃতির পাহাড়টিতে যেতো আর ফিরতো না! গ্রামগুলো থেকে অতীব সাহসী যুবকদের একটি দল এর কারণ অনুসন্ধানে গিয়ে দেখতে পায়, সেই পাহাড়ের চূড়ার গর্তে এক ভয়ঙ্কর দর্শন বগা বাস করে। বম ভাষায় বগা মানে ড্রাগন। তারা কয়েকজন মিলে ড্রাগনটিকে আক্রমণ করে হত্যা করে ফেলে। ড্রাগনটির মৃত্যুর সাথে সাথে ড্রাগনের গুহা থেকে ভয়ঙ্কর গর্জনের সঙ্গে আগুন বেরিয়ে এসে পুড়ে দেয় আশপাশ। নিমিষেই সেই পাহাড়ের চূড়ায় মনোরম একটি পাহাড়ি লেকের জন্ম হয়, যার নাম দেয়া হয় বগাকাইন লেক বা বগা লেক।


বগা লেকে যেহেতু নামা নিষেধ, সেখানে ‘মগ পদ্ধতি’ চালু আছে। সেটা এক জিনিস বটে! লম্বা একটা হাতল ওয়ালা মগ। সবাই সেই মগ পদ্ধতিতে লেকের বরফ শীতল পানিতে শরীরের সব ক্লান্তি দূর করে নিল। এরপর আমরা হাঁটতে বের হলাম। রাতের অন্ধকারে অনেকটা দূর চলে গেলাম যেখানে আকাশভরা শুধু জ্বলজ্বল করছে তারা। এতো তারা একসাথে দেখে আমি হা হয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। সারাজীবন ইট-কাঠের শহরে মানুষ হয়েছি। আকাশের দিকে তাকালে জমাট বাঁধা শুধু কার্বন ডাই অক্সাইড দেখেছি। পরিষ্কার স্বচ্ছ আকাশ ভরা তারা, এতো বেশি সংখ্যায় যে মনে হচ্ছিলো এতো বড় আকাশটাতেও জায়গার জন্যে যুদ্ধ করতে হচ্ছে তাদের, এমন দৃশ্য আমার জন্যে অক্সিজেনের কাজ করছিল। জীবনে প্রথম সেখানে আমি খসে পড়া তারা দেখলাম। চট করে চোখ বুজে কি কিছু চেয়েছিলাম?


ওখানে ফরমালিন মুক্ত পাকা পেঁপের স্বাদ নিলাম সবাই। খুব মিষ্টি! তারপর রাতের খাবারে আলু ভর্তা, মুরগী আর ডাল গোগ্রাসে গেলা হলো। খাবার অনেক ভালো ছিল। খেয়ে সবাই ঘুম। পরদিন সকালে রওনা হতে হবে পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। শক্তি সঞ্চয় না করলে হবে কেন!


ভোরে উঠে আমরা কয়েকজন একটু হেঁটে আসলাম। বগালেকের সৌন্দর্য সকালের সূর্যের আলোতে যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে! স্বচ্ছ নিথর পানি, চারপাশে পাহাড়ের ছায়া, ছোট ছোট মাছ, ফুটে থাকা শাপলা… এক ভিন্ন জগতে নিয়ে যায়। বুঝলাম, বগা লেক একেক বেলায় একেক রূপে হাজির হয়। কিছুক্ষণ কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করে ফিরে গেলাম কটেজে। সকালের নাস্তায় খিচুড়ি-ডিম খেয়ে সবাই ব্যাগ-প্যাক বেঁধে তৈরি। দূর্ভাগ্যবশত তুহিন আপু-ভাইয়া বগালেক থেকেই বিদায় নিলেন। যানজটের কারণে আমাদের দুইদিনের ট্যুর তিনদিন করা হয়েছিল। ওনাদের পক্ষে ছুটি নেয়া সম্ভব হয় নাই।


তেহজীব বান্দরবান পৌঁছানোর পর থেকে একই প্রশ্ন করে যাচ্ছে, ‘পাহাড় কই? আমি না পাহাড়ে যাবো?’ ওকে ওর মাপের একটা বাঁশ কেটে হাতে দেয়া হলো। আমরা সবাই বাঁশ নিয়ে নিলাম। সকাল তখন পৌনে নয়টা, আমরা হাঁটা শুরু করলাম। সাথে গাইড জিরাম। একদল অভিযাত্রী, কোনরকম কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই, একসময় বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চূড়া বলে খ্যাত ‘কেওক্রাডং’ এর বুকে পা ফেলার স্বপ্ন নিয়ে হাঁটতে লাগলাম।


তেহজীব আর মুশতাককে নিয়ে আমি খুব ভয়ে ছিলাম। মেয়ে হাঁটতে পারবে? মুশতাক এতোটা পথ কিভাবে কোলে করে নিবে? আরো কতো দুশ্চিন্তা! কিন্তু আমাদের মেয়ে সবাইকে অবাক করে সেইরকম শারীরিক দক্ষতা আর মানসিক শক্তির পরিচয় দিল। প্রায় ৮০% পথ সে একা হেঁটে উঠেছে। পাহাড়ে ওঠার পথে আরো যারা ট্যুরিস্ট ছিলেন, কেউ নামছিলেন, কেউ উঠছিলেন, সবার এক চিন্তা— বাচ্চাটা পারবে? পাহাড়ে ওঠার এক পর্যায়ে উঁচু একটা জায়গায় একটা গ্রুপ বসে বিশ্রাম করছিল। তেজু যখন বাঁশ হাতে খাড়া পথটা উঠলো, সবাই একসাথে হাততালি দিয়ে ওকে অভিবাদন জানালো। দৃশ্যটা এতো সুন্দর ছিল! আর আমার কথা যদি বলি, আমি উঁচুতে উঠতে গেলে দ্রুত হাঁপিয়ে উঠি। কিন্তু সেই সময়, সেই মুহূর্তে নিজেকে যাচাই করে নেয়ার তাগিদ ছিল, আমাকে তো উঠতেই হতো। নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস এতোই বেড়েছে যে এখন আরো অনেক পাহাড়-পর্বত পাড়ি দেয়ার অপেক্ষায় আছি!


কেওক্রাডং যাওয়ার পথে চিংড়ি ঝর্ণা দেখা যায়। ঝর্ণার কাছে আমি চুপচাপ একটা পাথরে বসে ছিলাম। বাকিরা ঝর্ণায় যেয়ে গা ভিজিয়ে আসলো। কাছে থেকে ঝর্ণাটা অনেক সুন্দর, ঝিলমিল করে! পাথর আর ঠান্ডা পানি মিলেমিশে ঝকঝকে দেখা যায়। সেখানেও বসে পাকা পেঁপে খেলো সবাই।


কিছু সময় এখানে কাটিয়ে আমরা আবার হাঁটা শুরু করলাম। বেলা প্রায় সাড়ে বারোঁটা, আমরা যেয়ে পৌঁছালাম দার্জিলিং পাড়ায়। চমৎকার সাজানো গোছানো পরিচ্ছন্ন একটা পাড়া। খুবই ভালো লাগছিল। ট্র্যাকিংয়ের ক্লান্তি পাড়াঁটা ঘুরে দেখায় ব্যাঘাত ঘটাতে পারেনি। সুন্দর একটা ছোট্ট গীর্জাও ছিল পাড়ায়। সেখানে এক দোকানে বসে আদা চা খেলাম সবাই মন ভরে। চা টা খুবই ভাল ছিল। পাহাড়ি আদাগুলো এতো ঝাঁঝ হয়! চা খেয়ে একেবারে চাঙা হয়ে গেলাম। তরিকুল ভাই দেখলাম কলা পাতায় মোড়ানো কি একটা খাবার অর্ডার করলেন। দেখি লাল লাল ভাতের মতো, উপরে একটু গুড়, আর মনে হয় নারকেল মাখানো ছিল। জিজ্ঞেস করে জানা গেল এর নাম ‘থাও বুহ’। লাউয়ের খোলে রান্না করতে হয়। চুলায় করলে বুহ মানে ভাতটা বেশি থাও অর্থাৎ আঠা বা নরম হয়ে যায়। এরপর শুরু হলো আমাদের কথায় কথায় ‘থাও’ বলা। থাও মানে বেশি, থাও মানে অতিরিক্ত। এই ‘অতিরিক্ত’ শব্দটা যে আমরা এতো অতিরিক্ত বলছি এই দুইদিনে!


দার্জিলিং পাড়া থেকে বের হয়ে আবার আমরা হাঁটতে লাগলাম। আর বেশী বাকি নেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর। অনেকে দেখছিলাম চান্দের গাড়িতে যাচ্ছেন। এই পাহাড়ি সরু, আঁকাবাঁকা রাস্তায় গাড়িতে যাওয়া…! আমার মনে হচ্ছিলো, জীবন বাজি রেখে যাচ্ছে ওরা। আর তেহজীব বলছিল, ‘মানুষ গাড়িতে যায় কেন? হেঁটেই তো মজা!’ শেষ পথটুকু অনেক খাড়া। তাতে কি! যেতে যেতে আমরা মাঝে একটু থামছিলাম। পাহাড় দেখছিলাম, গর্ব আর আনন্দ অনুভব করছিলাম। এখানের পাহাড়গুলো আমাদেরই। একান্তই আমাদের। কি তার বিশালতা! পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে অদ্ভুত এক রহস্য লুকিয়ে থাকে! বুক ভরে শ্বাস নিয়ে আবার পথ চলা শুরু করলাম। একটা সময় কাঙ্খিত চূড়া দৃষ্টিগোচর হচ্ছিলো আর আমাদের উত্তেজনা বাড়ছিল।


কেওক্রাডং একসময় বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ছিল। এখন এর অবস্থান পঞ্চমে। উচ্চতায় ৩১৭২ ফুট। কেওক্রাডং শব্দটি মারমা ভাষা থেকে এসেছে। মারমা ভাষায় কেও মানে ‘পাথর’, কাড়া মানে ‘পাহাড়’ আর এবং ডং মানে ‘সবচেয়ে উঁচু’। অর্থাৎ কেওক্রাডং মানে সবচেয়ে উঁচু পাথরের পাহাড়। লালা বম বলেছিলেন, ‘কেওক্রাডং’- এর ভাব অনুবাদ হচ্ছে, পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করা। আমরা চূড়ায় পৌঁছালাম। এতোটাই বিমোহিত আর আনন্দিত ছিলাম যে চিৎকার করার কথা মনেই হয়নি। আমি ভাবছিলাম, আমি পেরেছি সত্যি! আর আমার ছোট্ট মেয়েটা…. ততোক্ষণে ওর নাম হয়ে গিয়েছে ‘ইন্সপিরেশন’, অনুপ্রেরণা! পাহাড়ে কোন মোবাইল নেই, নেটওয়ার্ক নেই। জাগতিক সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন আমরা। সম্বল শুধু মুখোমুখি বসে কথা বলা, একে অপরকে দেখা পাশাপাশি বসে। মুশতাক পরে বলেছে, পাহাড়ে যাওয়ার পর জীবনের প্রতি, সম্পর্কের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ওর বদলে গিয়েছে।


কেওক্রাডং আর্মি ক্যাম্পে নাম এন্ট্রি করে পাহাড়ের কোলে একটা কটেজে উঠলাম আমরা। দুপুরে খেয়ে এসে সবাই শুয়ে পড়লো। এদিকে হলো কি, ফ্রেশ পাহাড়ি পেঁপে খেয়ে ইমন ভাইয়ের পেটে অতিরিক্ত সমস্যা হয়ে গেল। ইমন ভাই আর সৈকত এই ট্যুরে যারপরনাই প্যারা সহ্য করেছে সবার। কোন কুক্ষণে ইমন ভাই যেয়ে সৈকতের খোঁজখবর করছিল। আর ব্যস! সবাই ওদের দোস্তানা নিয়ে মজা শুরু করলো। শেষ পর্যন্ত এমন হলো, এরা পঁচানি খাওয়ার ভয়ে কথাই বলে না। এই ট্যুরে সবার কিছু না কিছু স্ক্যান্ডাল হয়েছে। কারো নরমাল, কারো হরমোনাল!


বিকালে উঠে সূর্যাস্ত দেখতে হেলিপ্যাডে গেলাম আমরা। গোধুলির মিষ্টি নরম আলোতে কাশফুলগুলো কি সুন্দর রঙ হয়ে যায়! এতো ভালো লাগছিল! কিন্তু প্রচন্ড ঠাণ্ডায় টেকা দায়। রাতের খাবার পর্ব চুকিয়ে ঘরে ফিরে সবাই কম্বলের নিচে। হোষ্ট ইমরান ভাই ঘোষণা করলেন, সবাই মিলে আড্ডা হবে, গান হবে। এক এক করে সবাই অনেক কথা বললো, কেউ গান গাইলো, কেউ কবিতা শোনালো। ইমন ভাইয়ের কন্ঠে ‘আমার একলা আকাশ’ অসাধারণ ছিল। গানটা শুনলে এখনো ভাইয়ার কথাই মনে হয়। তরিকুল ভাইয়ের আবৃত্তি বহুদিন মনে থাকবে। আর ইমরান ভাইয়ের কথা কি বলবো! মন্দিরা হাতে যখন ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ গানটা ধরলেন, ওনার চেহারার দরদটা আমি শুধু দেখছিলাম। লাজুক রাসেল ভাইয়ের শেষ পর্যন্ত গাওয়া গানটা ভালো ছিল। শান্তি আর আয়শার কন্ঠ কি বলবো! করল্লার মতো মিষ্টি! করল্লার সাথে তুলনা দেয়াটা আমাদের দুষ্ট গ্রুপের আরেকটা মিষ্টি সংলাপ ছিল। সৈকত যখন ছড়া শোনাচ্ছিল, মনে হচ্ছিলো সামনে ওর ছেলেটা বসে আছে। আমার বুড়ির গান মানে এত্তোগুলা ভালোবাসা। আর মুশতাক যখন আমার পছন্দের গানটা গাইলো, মনে হয়েছে পুরানো দিনে ফিরে গিয়েছি। কতোবারো ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া….তোমারও চরণে দিবো হৃদয়ও খুলিয়া .. সেই রাতের গল্প-কবিতা-গান আমাদের এই ১০ জন মানুষকে অনেক কাছে নিয়ে এসেছিল।


পরদিন খুব ভোরে উঠে সূর্যোদয় দেখতে গেলাম আবার হেলিপ্যাডে। খুব দ্রুত সূর্যটা উঠে গেল মনে হলো। সকালের নাস্তা সেরে এবার পাহাড় থেকে নামার পালা। আমার মনে হয়েছে, নামার চেয়ে পাহাড়ে ওঠা সহজ। ওঠার সময় নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখা যায়। কিন্তু খাড়া নামার সময় সেটা সম্ভব হয় না। ফেরার পথে আমরা আবার দার্জিলিং পাড়ায় থেমে চা খেয়ে নিলাম। নামতে আমাদের সময় কম লেগেছে। এটাই স্বাভাবিক। তেজু প্রায় পুরো পথটাই একা নেমেছে। মেয়ে আমার আস্ত একটা পাহাড় জয় করে ফিরেছে!


আমরা বগালেকে গোসল সেরে নিলাম। লেকের ঠান্ডা পানিতে পা ডুবিয়ে যখন দাঁড়িয়ে ছিলাম, ছোট মাছগুলো এসে পায়ে ‘ফিস স্পা’ দিচ্ছিলো। আঙুলের ফাঁকে এসে হালকা ঠোকর দিচ্ছিলো। খুব মজা পেয়েছি। আমরা খাওয়া সেরে ফেরার জন্য তৈরি হলাম। শুনলাম চান্দের গাড়ি লেক পর্যন্ত আসতে পারবে না।

আমাদের একটা ভীষণ খাড়া আর সরু পথ বেয়ে অনেকটা সময় হেঁটে চান্দের গাড়ির কাছে যেতে হলো। তারপর রওনা করলাম। বান্দরবান থেকে রাস্তা হচ্ছে বগালেক, এবং পরে কেওক্রাডং পর্যন্ত হবে। নির্মাণ কাজের জন্য রাস্তায় প্রচন্ড ধুলা। জমিয়ে গান গাইতে গাইতে আমরা যখন বান্দরবান পৌঁছাই, শরীরে মনে হয় কয়েক কেজি ধুলা! এখন কিন্তু এই রাস্তাটা হয়ে গিয়েছে। চান্দের গাড়িতে আরামে চলাচল করতে পারেন পর্যটকেরা। যাওয়ার সময় আমরা যেসব জায়গায় এন্ট্রি করেছিলাম, ফেরার পথে সেখান থেকে এক্সিট নিতে হয়েছে। এতো স্বাক্ষর মনে হয় জীবনেও করি নাই!


সময়মতো আবার ফিরতি পথ ধরলাম। ফেরার পথেও কুমিল্লায় জ্যামে আটকে ছিলাম। যদিও বিরক্তি, রাগ সবকিছু ছাপিয়ে মন খারাপ লাগছিল। চমৎকার সঙ্গ আর সময়গুলোকে পেছনে ফেলে যেতে কারই বা ভালো লাগে!


বিঃদ্রঃ ঘুরতে গেলে আমরা জায়গা নোংরা করি না। যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলি না। দেশটা আমাদের। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখাও আমাদেরই দায়িত্ব।

Share Article:

Tamanna Azmi

Writer & Blogger

All content published on Jatrik Blog is the intellectual property of the respective authors. Jatrik Blog serves as a platform for sharing these personal travel experiences with the world.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

যাত্রিক - Jatrik

যাত্রিক-এ আমরা বিশ্ব আবিষ্কারের প্রতি গভীর আগ্রহী এবং মনোমুগ্ধকর ব্লগ এবং ভ্লগের মাধ্যমে ভ্রমণের আনন্দ শেয়ার করি। আমাদের মিশন হলো সহযাত্রী ভ্রমণকারীদের মধ্যে ভ্রমণের ইচ্ছা জাগানো, প্রয়োজনীয় পরামর্শ, চমৎকার দৃশ্যাবলি এবং আমাদের অভিযানের প্রামাণিক গল্পের মাধ্যমে।

আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আমাদের পাঠান, যাতে তা জাত্রিক বাংলা ব্লগে শেয়ার করা যায়। লেখা পাঠান এই ঠিকানায়ঃ

jatrik.com@gmail.com

ইন্সটাগ্রাম এ ফলো করুন

সর্বোশেষ পোস্ট সমূহ

  • All Post
  • ঐতিহাসিক
  • খাবার গল্প
  • পাহাড় ও পর্বত
  • ফটোগ্রাফি
  • বাংলাদেশ
  • বিদেশ ভ্রমন
  • ভ্রমন

Visit kunjori

for your desired jewellery collection

আমাদের সাথে যোগ দিন

ণিউজলেটার এর জন্য সাইন আপ করুন

You have been successfully Subscribed! Ops! Something went wrong, please try again.
Edit Template

যাত্রিক

স্বাগতম যাত্রিক ব্লগ সাইটে, যা আপনার যাত্রার প্রেরণা, গল্প এবং পরামর্শের নির্ভরযোগ্য স্থান। যাত্রিক ইভেন্টস অ্যান্ড ট্রাভেলস-এর একটি সহযাত্রী প্রতিষ্ঠান হিসেবে, আমরা আপনাকে বাংলাদেশের জনসাধারনের হৃদয়ের কাছাকাছি নিয়ে আসার লক্ষ্যে কাজ করছি।

সাম্প্রতিক পোস্ট

  • All Post
  • ঐতিহাসিক
  • খাবার গল্প
  • পাহাড় ও পর্বত
  • ফটোগ্রাফি
  • বাংলাদেশ
  • বিদেশ ভ্রমন
  • ভ্রমন

সোশাল মিডীয়া লিঙ্ক

© 202৪ Copyright Jatrik.com